september 28, 2020
বাংলাদেশে ধর্ষণের যে বাজে অবস্থা , তাতে কী করা যেতে পারে তা সম্পর্কে আলোচনায় এমন আলাপ উঠে এসেছে যে তাড়াতাড়ি ছেলে মেয়ে সবার বিয়ে দেয়া উচিত।
আলাপ ১ঃ বিয়ে ধর্ষণ থামাবে।
বিয়ে ধর্ষণ থামাতে পা্রে না কারণঃ
১। ধর্ষণ যৌন আকাংক্ষার কোন বিষয় নয়, এটা ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয়। এখন এই ক্ষমতা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, লিঙ্গ বৈষম্যের ফলে সৃষ্ট পুরুষতান্তিক ক্ষমতা যেকোনটাই হতে পারে। যেমন বৃটিশরা যখন ভারতীয়দের বা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনি বাংলাদেশী নারীদের ধর্ষণ করেছে, তা যৌনাকাঙ্ক্ষায় না বরং ক্ষমতা দেখাতে। এ কারণে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে হেরে যাওয়া বা বিরোধী পক্ষের দলের নারীদের ? আত্মীয়াদের হামলা করা হয়। নাতসি ক্যাম্পে প্রচুর ইহুদি নারী ধর্নেষ্রণের শিকার হয়েছিলেন কারণ জার্মানরা তাদের গর্ভধারণের মাধ্যমে আর্য্রক্তের শিশু ভূমিষ্ঠ করতে চাইত। লাতিন আমেরিকায় নারীদের সাদারা ধর্ষণ করেছিল যেন ক্রিওলের মাধ্যমে লাতিন পুরুষদের চিহ্নকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়। নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায় এমনকি তুষার যুগের আগে গোত্র ভিত্তিক যে সমাজ, যেখানে যৌন মিলন আজকের তুলনায় অবারিত ছিল, এমনকি ৮-১০ বছরের শিশুরাও যৌনাচারের নকল করত, সেই সমাজেও ধর্ষণ ছিল।
২। এই কারণেই পুরুষ পুরুষকে ধর্ষণ করতে পারে। ধর্ষণ মানে আপনার শরীরের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণকে চরমভাবে লঙ্ঘন করা, এই লঙ্ঘনের অপমান সাংঘাতিক। সেই অবদমনের জন্যই ধর্ষণ করা হয়।
৩। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে চেনে না জানে না এমন নারীকে একজন পুরুষ কেন ধর্ষণ করবে? এখানেও ক্ষমতা। পুরুষতান্ত্রিকতা শেখায় যে পুরুষই মানুষ, নারী আসলে দমিয়ে রাখার জিনিস, সে মানুষ না, মেয়ে মানুষ। তাই আমার যদি একটা মেয়ে দেখে মনে হয়, আরে একে নিয়ে তো রগড় করা যায়, তো আমি ধর্ষণ করব,। ঠিক যে কারণে অকারণেই রাস্তার কুকুরকে, পুকুরের ব্যাঙ কে মানুষ ঢিল মারে, সেই একি মনস্তত্ত্ব।
৪। পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার আরেক সমস্যা হল, এমন সমাজে কোন অবহেলিত, জীবনযুদ্ধে জর্জরিত পুরুষ দেখে একজন নারী তাঁর চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে, তার পৌরুষ তখন জেগে উঠে এবং বলে এই মেয়েকে তাঁর জায়গা দেখিয়ে দেয়া উচিত। আমি চাকরি পাইনা, আর এই খা** চাকরি করে? দেশ বিদেশ ঘুরে? দেখি তো তোর শরীর নষ্ট করে তখন তোর কয় পয়সা দাম থাকে?
৫। পুরুষতন্ত্র শেখায় নারীর সম্মান তাঁর ভ্যাজাইনা/ যোনীপথে। তাই ধর্ষণকামী পুরুষ ভাবে ধর্ষন করতে পারা মানে জিতে যাওয়া, দমন করা, কে আসল ক্ষমতার অধিকারী তা দেখিয়ে দেয়া।
আলাপ ২ঃ কম বয়সে অর্থাৎ ১৮র নিচে কিশোরকিশোরি অবস্থাতেই (বাল্য) বিবাহ দেয়া উচিত।
১। বাল্যবিবাহ যে মতান্তরে ধর্ষনের সামিল, সেটা মানুষের মাথায় আসে না।বাল্হযবিবাহ হলেও ধর্ষণ থামবে না, কারণঃ
যৌন মিলন কেবল তখনি মিলন যখন উভয় পক্ষের সম্মতি থাকে। একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক, সে যদি ১৭ বছরের-ও হয়, সেক্ষেত্রে সে জেনে বুঝে সম্মতি দিতে পারে না। সম্মতি যদি না থাকে, তাহলে তা ধর্ষণ। আমাদের দেশে মান্ধাতার আমলের আইনে বলা আছে স্ত্রীর বয়স ১৩র কম হলে বৈবাভিক মিলন ধর্ষণ হবে, যার মাধ্যমে বাল্যবিবাহের একরকম স্বীকৃতি দেয়া হয়। পৃথিবী যেখানে এগিয়ে গিয়েছে, সেখানে আমরা বাল্যবিবাহ থামানো না উলটো ধর্ষণ থামানোর জন্য ধর্ষণকে বৈধতা দেয়ার আলাপে মত্ত!
২। কচি মেয়ের সাথে মুশকো জোয়ান বা কাছাকাছি দুই কিশোরকিশোরী,সবরকম বাল্যবিবাহই অপরাধ। কেন? বাল্যবিবাহের মাধ্যমে একজন শিশু (মতান্তরে অপ্রাপ্তবয়স্কব্যক্তির) স্বার্থহানি হয়। বিয়ে এমন একটি সম্পর্কেযার সাথে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দায়দায়িত্ব জড়িত। বিয়ের মাধ্যমেযৌনমিলন বৈধতা পায়, কাজেই বাল্যবিবাহের পর যৌনমিলন অপরাধ ভাবা হয় না। অথচ চিকিৎসাশাস্ত্র বলে যে কৈশোরে মানুষের শরীর যৌন মিলনের প্রতিক্রিয়ার জন্য পূর্ণভাবেপ্রস্তুত হয় না। এটি মেয়েদের জন্য বেশি প্রযোজ্য। ঋতুবতী হলেই মেয়ে বিয়ের উপযুক্তহয় বলে একটা কথা আছে। তারা এটা ভুলে যান যে ডিম্বাণু তৈরি মানেই যে গর্ভাশয় ভ্রূণবইবার জন্য শক্তপোক্ত প্রস্তুত হয়েছে তা না। অনেক মেয়ের ৯ বছর বয়সে ঋতু হয়। ১০ এবিয়ে দেই আমরা তাহলে, নাকি?
২। বিয়ে করলেই বাচ্চা নিতে হবে কে বলল?
যে পরিবার বাল্যবিবাহ সমর্থন করে, সে পরিবারজন্ম নিয়ন্ত্রণে আস্থা রাখে ? এর ফলে ঐ মেয়েটির নিজের আত্মনিয়ন্ত্রন নষ্ট হচ্ছে,একটি কিশোর সময়ের আগেই দায়িত্বে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে এটা আমরা ভাবি না। আমাকে একজনবলল, ওরা বন্ধুর মত থাকবে, সংসার তো মাবাপ চালাবে তারা তো আছেই। তা মাবাপ যদিসংসার চালায়, তাহলে ছেলের বিয়ে দিয়ে আরেকতা সংসার তৈরির কথা ভাবা কেন? আর আমাদের মত সমাজে, মেয়ে (ঘরের বোউ) শুয়ে বসে খাচ্ছে, এতা মেনে নেবে শ্বশুরবাড়ি? বাক্যবাণে জর্জরিত করবে না? ঘরের বৌ শিক্ষার সুযোগ পাবে? চাকুরির সুযোগ পাবে? আর যদি বলেন মেয়ের জন্য “স্বামীর’ তাকাই সব, তাহলে আপনি আসলে মেয়েদের হাতের মুঠয় রাখতে চান। আপনি ধর্ষণ নিয়ে চিন্তিত না কারণ আপনি ভাবেন ধর্ষণ আসলে নারী স্বাধীনতার ফল।
৩। কম বয়সেবিয়ে দিলেই কিন্তু স্পাউসের প্রতি সহজাত ভালোবাসা জন্মায়
না। ১৬তে বিয়ে হল, ২৪ এ মনেহল এই মানুষের কথা বার্তা আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ হবেমানে তো এই না যে সারা বিশ্ব তা অনুসরণ করবে। পৃথিবী নিজের মত আগাবে। বাল্যবিবাহহওয়া মেয়ে/ ছেলে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে, পড়াশোনা শিখে, পৃথিবী সম্পর্কে জেনে তাঁরবিয়ে কি বঝার আগেই হয়ে যাওয়া বিয়ে থেকে থেকে মুক্ত হতে চায়, তখন? এমনকী ইসলাম ধর্মেও (রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিনা তাইবললাম) খায়ের উল বুলঘ নামে একটা নিয়ম আছে, যেখানে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ের পরপ্রাপ্ত বয়স্ক হলে তাঁকে সুযোগ দেয়া হয়, চাইলে সে বিয়ে থেকে বের হয়ে আসবে। এখানেশর্ত থাকে যে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয় নি। তা যারা বলছেন যে বিয়ে দিলে যৌনকামচরিতার্থ হয় কাজেই বিয়ে দিলে ধর্ষণ থামে, তারা ভাবুন যে কম বয়সে বিয়ে দিলে সেখানেযোউন সম্পর্ক না হওয়া বাস্তবসম্মত কিনা।
৪। বিয়ের দায়িত্ব নিতে পরিপক্ক হওয়া লাগে না, ১৮র কমে না হোক, ১৮ হলেই বিয়ে দেয়া উচিত
কম বয়সে নিজের সক্ষমতা, নিজের আশা আকাঙ্ক্ষাসম্পর্কে মানুষের ( এমনকী প্রাপ্তবয়স্কদেরও) স্পষ্ট জ্ঞান থাকে না। ফলে কম বয়সেহইয়া বিয়েতে ক্ষমতার/ সমতার ভারসাম্য না থাকলে হয় দাম্পত্য কলহ, দাম্পত্য সহিংসতাহবে (যদি মেয়ে/ ছেলে অসহায় হয় কারণ সহ্য করা ছাড়া সে কিছু করতে পারবে না), নয়ত বিয়ে ভাংবে, নয়ত পরকীয়া হবে, কারণ মানুষ প্রক্রিতিগতভাবে মুক্ত থাকতে চায়। যার সাথে ঘর করি, তাঁর সাথে মন না মিলিলে কেবল শরির দিয়ে বেশিদিন চলে না।
তো পরকীয়ারক্ষেত্রেও পুরুষের সুযোগ বেশি কারণ ছেলেদের বাইরে যাওয়ার, মেলামেশার সুযোগ মেয়েদেরচেয়ে বেশি।
আরেকটা উত্তর হবে, মেয়েদের বেশি পড়াশোনা শেখানো উচিতনা। তাই তো?
দেখুন, বিয়ের মধ্যেও কীভাবে ক্ষমতা চলে আসছে। বিয়ের সাথে ক্ষমতাই যদি না থাকে, তো যৌতুক আসল কিভাবে? দেনমোহর কত হবে এই নিয়ে বাজারের মত দরাদরি হয় কেন? স্ত্রীধন কেমন হবে তা নিয়ে তর্ক হয় কেন?
বাংলাদেশীরা এবং বাঙ্গালিরা বিয়েপাগল। আমাদের সব কিছু বিয়ে কেন্দ্রিক। পড়াশোনা কী নিয়ে করব, কেমন চাকুরি করব, কেমন ভাবে কথা বলব, চালচলন কেমন হবে, সব কিছুর পেছনে থাকে বিয়ে। “ওমা! ছেলেমানুষ ছবি আঁকবি? তা বৌকে খাওাবি কিভাবে? সে কি, মেয়ে মানুষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হবে? রাস্তার মিস্ত্রিগুলোর সাথে সারাদিন হাতাহাতি করবে? বিয়ে হিবে কিভাবে?” এমনকী আমাদের সমাজে একদম ন্যাদা বাচ্চাদের ব্যাপারেও বিয়ে নিয়ে মজা করা হয়। কার বিয়েতে কি পরা হবে, কেমন অনুষ্অঠান হবে, তা বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই আলাপের বিষয়। অবস্থা দেখলে মনে হয়, মানব জীবনের পরম লক্ষ্য বিয়ে, মানবজীবনের মোক্ষলাভ কেবল বিয়ের মাধ্যমে সম্ভব।
বিয়ে নিয়ে ফ্যান্টাসাইজ করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই, বিয়ে কেবল একটা উতসব না, তাঁর চেয়েও বড় কথা বিয়ে একটা বিশাল দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব যখন অপ্রাপ্তবয়স্কের ওপর চাপিয়ে দেয়া ।